শিক্ষণের নীতি

ভূমিকা: শিক্ষা মূলত শিখন এবং শিক্ষণের সমন্বয়। অর্থাৎ শিখন শিক্ষণ মিলে শিক্ষা সম্পন্ন হয়। এর সাথে মনোবৈজ্ঞানিক প্রত্যয়, শিখন এবং সার্বজনীন কল্যানকর চেতনায় শিক্ষণ জড়িত। শিখন এবং শিক্ষণ প্রক্রিয়াকে সফল ও সার্থক করে তুলতে হলে কতগুলো মনোবৈজ্ঞানিক নীতি অনুসরণ করতে হয়, যাদেরকে শিখন প্রক্রিয়ার নীতি বা শিখন প্রক্রিয়ার চিরায়ত নীতি বলে। এই নীতিগুলোকে আবার শিক্ষার চিরন্তন নিয়ম বা Maxim of Education রুপে অভিহিত করা হয়। এগুলো শিক্ষাক্ষেত্রে মনোবৈজ্ঞানিক শিখন প্রক্রিয়া বা Psychological Teaching Learning Process অথবা শুধুমাত্র Learning Process হিসেবে স্বীকৃত।

Maxim of Education মূলত Psychological Learning Process Rules অথবা Psychological Learning Rules এর সমরুপ। Psychological Learning Rules শিক্ষায় ভিন্ন নামে প্রবর্তিত হতে পারে। Maxim শব্দের অর্থ সাধারন নীতি, সাধারন নিয়ম, সুন্দর বাণী ইত্যাদি। কাজেই শিক্ষাক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের যথার্থ শিক্ষণ সুনিশ্চিত করার জন্য যে সকল স্বয়ংক্রিয় মনস্তাত্ত্বিক নীতির অনুসরণ করা হয় তাদেরকেই শিক্ষার সাধারণ নীতি বা Maxim of Education বলে।

শিক্ষায় অনুসরণযোগ্য Maxim of Education এর মধ্যে নিচের ৫টি ধাপ অনুসরণ করা যেতে পারে। যেমন:

১. শিখন হবে সহজ হতে কঠিন ধাবিতকরণ।
২. পাঠ হবে সমগ্র হতে অংশে অগ্রসর।
৩. শিখন হবে কাছে থেকে দূরে অগ্রসর।
৪. শিখন হবে বিশেষ হতে সাধারন এ উন্নীতকরণ।
৫. শিখন মনস্তাত্ত্বিক থেকে যৌক্তিক।

সহজ হতে কঠিন (Simple to Complex)

শিক্ষণের সময় বিষয়বস্তুকে যথাযোগ্যক্রমে বিন্যস্ত করা প্রয়োজন। শিক্ষার্থীরা প্রথম স্তরেই যদি কোন জটিল বিষয়ের সম্মুখীন হয় এবং যেখানে যদি অকৃতকার্য হয় তাহলে তার খারাপ প্রভাব শিক্ষার্থীদের উপর পরবে। এজন্য পাঠের বিষয়বস্তু উপস্থাপনের সময় সহজ হতে কঠিন আকারে সাজানো উচিত।
শিক্ষণের এই নীতি প্রয়োগের সময় আমাদের মনে রাখা উচিত যে, এর উদ্দেশ্য শুধু বিষয়বস্তুকে সহজ করা নয়। আমরা কেবলমাত্র সহজ অভিজ্ঞতা গুলো উপস্থাপন করব, একথা ঠিক নয়। সহজ ও সরল অভিজ্ঞতা দিয়ে শুরু করে ধীরে ধীরে জটিল পরিস্থিতির দিকে অগ্রসর হওয়াই আদর্শ শিক্ষণের বৈশিষ্ঠ্য। এটি মূলত সহজ থেকে কঠিন পদ্ধতির তাত্ত্বিক ভিত্তি।

উদাহরণ:
শ্রেনী: অষ্টম
বিষয়: সাধারণ বিজ্ঞান
শিক্ষণের নীতি: সহজ হতে কঠিন।
সহজ বিষয়: চুম্বকের আকর্ষণ।
কঠিন বিষয়: মহাকর্ষ ও অভিকর্ষ।

সমগ্র থেকে অংশ(Whole to Part):

আধুনিক মনোবিদ্যায় বলা হয়েছে, সমগ্র শিখন আংশিক শিখনের চেয়ে বেশি কার্যকর। শিক্ষণের সময় শিক্ষকের উচিত সবসময় সমগ্র বিষয় থেকে ধীরে ধীরে অংশের দিকে অগ্রসর হওয়া। এভাবে অগ্রসর হলে শিক্ষার্থী বিষয়বন্তুর সামগ্রিক তাৎপর্য সহজে উপলব্ধি করতে পারে। একটি কবিতা বা প্রবন্ধ সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে শিক্ষকের উচিত প্রথমত সমগ্র কবিতাটি বা প্রবন্ধটি উপস্থাপন করা। পরে প্রয়োজনবোধে বিশেষ অংশের উপর আলোচনা করা যেতে পারে। শিক্ষণের এই নীতি মনোবিজ্ঞানসম্মত এবং যেকোন শ্রেণীর পাঠের ক্ষেত্রে সমভাবে প্রযোজ্য।

উদাহরণ:
শ্রেণী: একাদশ
বিষয়: বাংলা সহপাঠ
শিক্ষণের নীতি: সমগ্র থেকে অংশ।
সমগ্র: সিরাজউদৌলা নাটক
অংশ: নাটকের সারসংক্ষেপ

কাছে থেকে দূরে(Near to Far):

জ্ঞানচর্চায় কাছে থেকে দূরে একটি উল্লেখযোগ্য মনোবৈজ্ঞানিক চেতনা। এ নীতির অনুসরণে শিক্ষার্থীর শিক্ষাকে জানা হতে অজানায় ধাবিত করা যায়, সহজ হতে কঠিনে ধাবিত করা যায় এবং মূর্ত থেকে বিমূর্তকরণ করা যায়। কাছে থেকে দূরে অগ্রসর হতে হবে। শিক্ষার্থীর জানার পরিসরের প্রথমেই আসে কাছে সবকিছু, তারপর দূরের জিনিস, জীবজন্তু ও বিষয়বন্তু। এই চেতনায় শিক্ষার্থীর শিক্ষণ শিখনে প্রথমে আসে কাছের চেনা-জানা বিষয় ঘটনা, বিষয়বস্তু এবং তারপর অন্যান্য দূরের বিষয়াবলী সন্নিবেশিত হবে। কারন কাছের সবকিছুকে চেনা-জানা না হলে দূরের জিনিস, জীবজন্তু, প্রকৃতি, ঘটনা কিংবা বিষয়বন্তু নিয়ে জ্ঞানচর্চা করা অবান্তর।

উদাহরণ
শ্রেণী: চতুর্থ
বিষয়: বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়
শিক্ষণের নীতি: কাছে থেকে দূরে
কাছে: বঙ্গোপসাগর
দূরে: প্রশান্ত মহাসাগর

বিশেষ হতে সাধারনে উন্নতি করণ(Particular to General):

শিক্ষা হল জটিল হতে কঠিন কর্মভাব। তাই এটি শিক্ষণ ও শিখন এর সমণ্বিত কর্মচর্চায় প্রতিফলিত। শিক্ষণ শিখনের একটি বিশেষ প্রক্রিয়া হল Particular to General অর্থাৎ শিক্ষার্থীর শিখন হবে অংশ হতে সাধারন অর্থাৎ নির্দিষ্ট হতে সাধারনে উপনিতকরণ। এখানে Particular এর অর্থ হল নির্দিষ্ট ক্ষুদ্রতম অংশ। কাজেই অর্থগত ভাবে বলা যায় শিক্ষণ শিখন কার্যক্রমে শিক্ষণীয় বিষয়বস্তুকে নির্দিষ্ট ক্ষুদ্রতম অংশ হতে সরু করে সাধারণে উপনীত করার প্রক্রিয়াকে বুঝায়। অর্থাৎ যে শিক্ষণ শিখনে শিক্ষার্থীদের শিক্ষার বিষয়বস্তুকে প্রথমে সুনির্দিষ্ট অংশ হকে সরু করে শেষ পর্যন্ত সাধারন ধারায় উপনীত করা হয় তাকেই শিক্ষা প্রক্রিয়ার অংশ হতে উপনীতকরণ বা Particular to General বলে।

উদাহরণ:
শ্রেণী: চতুর্থ
বিষয়: ইসলাম শিক্ষা
শিক্ষণের নীতি: বিশেষ হতে সাধারণ।
বিশেষ: নবীদের জীবনী
সাধারণ: ভালমন্দ কাজ শিখা

মনস্তাত্ত্বিক থেকে যৌক্তিক (Psychological to Logical):

শিক্ষণ কিংবা শেখানোর ক্ষেত্রে একটি বিশেষ নীতি হল মনস্তাত্ত্বিক থেকে যৌক্তিকতায় পাঠ পরিচালনা করা। মনোবৈজ্ঞানিক চেতনা হতে যৌক্তিক চেতনায় পাঠ পরিকল্পনা করকে হবে, যা শিক্ষার্থীর শিক্ষণ ও শেখার ক্ষেত্রে খুবই কার্যকরী। শিক্ষার্থীর শিক্ষণ হবে মনোবৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া বা নীতিনির্ভর। যুক্তিবাদের আলোকে শিক্ষার্থীর শিক্ষণ হবে যুক্তিনির্ভর এবং প্রমাণ সাপেক্ষ। শিক্ষণ শিখনের ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা নির্ভর বিষয়বস্তুকে যুক্তিনির্ভর করে প্রজ্ঞাময় বুদ্ধপ্রসূত রুপে সিদ্ধান্তে উপনীত করার দর্শনই হল যুক্তিবাদের মূল চেতনা।

উদাহরণ
শ্রেণী: অষ্টম
বিষয়: সাধারন বিজ্ঞান
শিক্ষণের নীতি: মনস্তাত্ত্বিক থেকে যৌক্তিক
মনস্তাত্ত্বিক : মরীচিকা
যৌক্তিক: দৃষ্টিভ্রম

One thought on “শিক্ষণের নীতি”

  1. শিক্ষার সাধারণনীতি তে simple to complex, known to unknown, inductive to deductive, concrete to abstract, definite to indefinite, analysis to synthesis এগুলো থাকলে ভাল হত।

Leave a Reply to Ayesha akter Cancel reply